নিউট্রিনো কি ?

আমরা জানি যে এই বিশ্বের সবকিছু পরমাণু দিয়ে গঠিত| পরমাণু এর কেন্দ্রে আছে একটি নিউক্লিয়াস যার চারপাশে কিছু ইলেকট্রন ঘুর্নায়মান| নিউক্লিয়াস এর ভিতরে আছে প্রোটন ও নিউট্রন| নিউট্রিনো ইলেক্ট্রন এর মত অতি ক্ষুদ্র একটি মৌলিক কণা, কিন্তু তা পরমাণুর অংশ নয়| একটি কণা যদি আরো ছোট টুকরো কণায় বিভাজ্য না হয় তাহলেই তাকে মৌলিক কণা বলা হয়| নিউট্রন এবং নিউট্রিনো - দুটি নাম শুনতে একই রকম হলেও চারিত্রিকভাবে তারা সম্পূর্ণ বিভিন্ন কণা| নিউট্রিনো কে গ্রিক অক্ষরে ν (নিউ) দ্বারা চিহ্নিত করা হয়| অতীতের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ফলাফল থেকে জানা যায় ইলেক্ট্রনের অনুরূপ আরও দুটি কণার নাম - মিউয়ন কণা এবং টাওয়ন কণা| মিউয়ন কণা একটি ইলেক্ট্রন কণার তুলনায় ২০০ গুণ ভারী এবং টাওয়ন কণা একটি ইলেক্ট্রন কণার তুলনায় ৩৫০০ গুণ ভারী| এই তিনটি কণার প্রত্যেকটির সাথে যুক্ত আছে একটি করে নিউট্রিনো - ইলেক্ট্রনের সাথে ইলেক্ট্রন নিউট্রিনো, মিউয়ন এর সাথে মিউয়ন নিউট্রিনো এবং টাওয়ন এর সাথে টাওয়ন নিউট্রিনো | ইলেক্ট্রন, মিউয়ন এবং টাওয়ন কণা ঋণাত্মক তড়িতধর্মী| কিন্তু নিউট্রিনোর তড়িৎ আধান শুন্য এবং প্রায় ভরহীন| তিনটি ইলেক্ট্রন ও তিনটি নিউট্রিনো - এই ছয় কণাকে একত্রে লেপটন বলা হয়|

কোথায় উৎপাদিত হয় নিউট্রিনো ?

নিউট্রিনো প্রকৃতিতে বহুল পরিমানে পাওয়া যায়| সূর্য, নক্ষত্র এবং বায়ুমন্ডলে প্রতি মুহুর্তে কোটি কোটি নিউট্রিনো তৈরি হয়| এই নিউট্রিনোগুলির অধিকাংশ আমাদের শরীরের ভিতর দিয়ে চলে যায় কিন্তু আমরা তা উপলব্ধি করতে পারি না| এমনকি এই কণাগুলি পৃথিবীকেও অনায়াসে ভেদ করে চলে যেতে পারে| তার কারণ নিউট্রিনো তার চলার পথে কোনো কিছুর সাথে বিক্রিয়া করে না| সহজ কথায় বিক্রিয়া করার মানে হল কণার বিভিন্ন ধর্ম যেমন গতি, অভিমুখ ইত্যাদির পরিবর্তন| উদাহরণস্বরূপ, টর্চের আলো তার সামনের প্রাচীর কে ভেদ করতে পারে না কারণ আলোর কণা প্রাচীর এর সাথে বিক্রিয়া করে তা ভেদ করার আগেই চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে| যেহেতু নিউট্রিনোর বিক্রিয়া করার ক্ষমতা খুবই কম তাই তা আমাদের কোনো ক্ষতি করে না| কৃত্রিম উপায়েও নিউট্রিনো তৈরি করা যায়| তেজস্ক্রিয় ক্ষয় এবং পারমাণবিক চুল্লিতে নিউট্রিনো উত্পাদিত হয়|

নিউট্রিনোর দোলন

নিউট্রিনো প্রকৃতিতে প্রচুর পরিমানে পাওয়া গেলেও, এর ক্ষীণ বিক্রিয়া ক্ষমতার কারণে গবেষণাগারে এই কণা সনাক্ত করা অত্যন্ত কঠিন| তা সত্তেও বিজ্ঞানীরা এই কণাকে সনাক্ত করার নানা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন| প্রথমে এই কণাকে ভরহীন বলে চিহ্নিত করলেও সাম্প্রতিক পরীক্ষায় জানা গেছে যে প্রকৃতপক্ষে এদের খুব সামান্য ভর আছে| এইধরনের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় নিউট্রিনো সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আবিস্কৃত হয়েছে যে তারা এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাবার পথে এক প্রকার থেকে অন্য প্রকারে পরিবর্তিত হতে পারে| উদাহরণস্বরূপ, সূর্যের ভিতর উৎপাদিত একটি ইলেক্ট্রন নিউট্রিনো পৃথিবীতে আসার পথে একটি মিউয়ন অথবা টাওয়ন নিউট্রিনো তে পরিবর্তিত হতে পারে| এই রূপান্তর প্রক্রিয়াকে নিউট্রিনোর দোলন বলা হয়|
নিউট্রিনোর ভরের প্রথম ইঙ্গিত পাওয়া যায় নিউট্রিনো দোলন এর আবিষ্কার থেকেই| শুধুমাত্র সূর্যে উৎপাদিত নিউট্রিনোরই যে এই বৈশিষ্ট্য দেখা যায় তা নয়, সব নিউট্রিনোর ক্ষেত্রেই, তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়া নির্বিশেষে, তা সত্য| নিউট্রিনোর ভর আছে - এই তথ্য আমাদের ব্রহ্মান্ড সম্পর্কে বর্তমান ধ্যানধারণাকে এবং অণু পদার্থবিদ্যা ( নিউক্লিয়ার ফিজিক্স), কণা পদার্থবিদ্যা (পার্টিকেল ফিজিক্স), জ্যোতিপদার্থবিদ্যা (আস্ট্রফিজিক্স) এবং সৃষ্টিতত্ব (কসমলজি) বিষয়ক বিজ্ঞান গবেষণাকে প্রভাবিত করে . ২০০২ সালের পদার্থবিজ্ঞান এ নোবেল পুরস্কার ও দেয়া হয়েছিল নিউট্রিনো বিষয়ক গবেষণাকে কেন্দ্র করেই|


ভারত-ভিত্তিক নিউট্রিনো মানমন্দির

নিউট্রিনোর দোলনের আবিষ্কার নিউট্রিনো গবেষণায় একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ মাত্র| এই বিষয়ে অনেক প্রশ্নের উত্তরই এখনো বিজ্ঞানীদের অজানা| বিজ্ঞান গবেষণার এই ক্ষেত্রটি তাই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বিজ্ঞানীদের আকৃষ্ট করেছে| জাপানের সুপার কামীয়কান্ডে নিউট্রিনো মানমন্দির, কানাডার সাদবারী নিউট্রিনো মানমন্দির, ইতালির গ্রান-সাসো গবেষণাগার, দক্ষিণ মেরুর আইসকিউব নিউট্রিনো মানমন্দির পৃথিবীর নিউট্রিনো গবেষণাগারগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য| কয়েক বছর আগে ভারতবর্ষেও একটি বিশ্বমানের নিউট্রিনো গবেষণাগার গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়, যার পরিণাম ভারত-ভিত্তিক নিউট্রিনো মানমন্দির (আই এন ও)|

একাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় আই এন ও প্রকল্পকে একটি বৃহৎ বিজ্ঞান প্রকল্প হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে|

আইক্যাল যন্ত্র ও নিউট্রিনো গবেষণা

প্রাথমিক পর্যায়ে আই এন ও পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত নিউট্রিনো কণা সনাক্তকারী একটি যন্ত্র তৈরি করবে| বায়ুমন্ডলে নিউট্রিনো ছাড়াও অন্যান্য কণা থাকার কারণে এই যন্ত্রে নিউট্রিনোর সংকেতকে অন্য কণার সংকেতের চাইতে আলাদা করে সনাক্ত করা দুরূহ হয়ে দাড়াবে| নিউট্রিনো ব্যতীত অন্যান্য কণাকে এই যন্ত্রে না পৌছুতে দেবার একটি উপায় হলো যন্ত্রটিকে কোনো পাহাড়ের নিচে স্থাপন করা| নিউট্রিনো যেহেতু যেকোনো বস্তুর ভেতর দিয়ে অনায়াসে ভেদ করে চলে যেতে পারে, তাই তা সহজেই যন্ত্রে পৌছুবে কিন্তু অন্যান্য কণা পাথরের দেয়ালে আটকে যাবে|

নিচের ছবিতে নিউট্রিনো কণা সনাক্তকারী যন্ত্রটিকে দেখানো হয়েছে যার নাম আয়রন ক্যালোরিমিটার (আইক্যাল)| এই যন্ত্রটি তিনটি অনুরূপ অংশে বিভক্ত যার প্রত্যেকটির আয়তন ১৬ মি. x ১৬ মি. x ১৪.৫ মি.| এটি ১৫০টি তলায় বিভক্ত এবং ২৮,৮০০ রেজিস্টিভ প্লেট চেম্বার (আর পি সি) নামক কণা সনাক্তকারী যন্ত্রের সমষ্টিতে তৈরি| প্রতি দুইটি তলার অন্তর্বর্তী অংশে থাকবে লোহার পাত| ৩৬ লক্ষেরও বেশি বৈদ্যুতিন পথে আর পি সি থেকে কণা উৎপাদিত সংকেত কম্পুটারে পাঠানো হবে| যন্ত্রের ভেতর তড়িৎকুন্ডলীর সাহায্যে চুম্বকক্ষেত্র সৃষ্টি করা হবে| এই বৃহদাকার যন্ত্রটির ওজন হবে ৫০০০০ টন এবং এটি হবে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ তড়িৎচুম্বক| ঠিক যেমনটেলিস্কোপের সাহায্যে দৃশ্যমান আলোর মাধ্যমে আমরা আকাশ পর্য্যবেক্ষণ করে থাকি, তেমনি আইক্যাল যন্ত্র নিউট্রিনোর মাধ্যমে আকাশ পর্য্যবেক্ষণ করবে|



আইক্যাল যন্ত্রের দ্বারা নিউট্রিনোর দোলন পরিমাপ

যেহেতু নিউট্রিনো ব্যতীত অন্যান্য মহাজাগতিক কণা পাহাড়ের গুহায় অবস্থিত আইক্যাল যন্ত্রে পৌছুতে পারবেনা, তাই এই যন্ত্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিউট্রিনোই সনাক্ত হবে| ওপরের ছবিতে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে নিউট্রিনো উৎপাদনের প্রণালী বিবৃত করা হয়েছে|



প্রাথমিক মহাজাগতিক কণা পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে নিউট্রিনো উৎপাদনের মূল উৎস যা প্রধানত মিউওন নিউট্রিনো ও ইলেকট্রন নিউট্রিনো ২:১ অনুপাতে তৈরি করে| নিউট্রিনোর এক প্রকার থেকে অন্য প্রকারে পরিবর্তিত হবার সম্ভাবনা সে কতটা পথ পার হয়ে এসেছে এবং তার শক্তির ওপর নির্ভর করে| পৃথিবীর উপরিভাগ থেকে আসা নিউট্রিনো পৃথিবী ভেদ করে আসা নিউট্রিনোর তুলনায় কম পথ পার হয়ে যন্ত্রে পৌঁছয় ও তাই তার অন্য প্রকার নিউট্রিনোতে পরিবর্তিত হবার সম্ভাবনাও অপেক্ষাকৃতভাবে কম| তাই যন্ত্রের উপর ও নীচ থেকে আসা নিউট্রিনোর অনুপাতের পরিমাপ নিউট্রিনো দোলনের সম্ভাবনা গণনা করতে সাহায্য করে|

নির্মাণস্থলের অবস্থান ও সুযোগসুবিধা

আই এন ও পাহাড়ের মধ্যে দুটি গুহা তৈরি করবে| একটি গুহার আয়তন ৪৮ মি. (দৈর্ঘ্য) x ১৬ মি. (প্রস্থ) x ১৪.৫ মি. (উচ্চতা) যেখানে থাকবে আইক্যাল যন্ত্র ও অন্যটিতে থাকবে কম্পুটার এবং অন্যান্য বৈদ্যুতিন নিয়ন্ত্রণ ওপর্যবেক্ষণ যন্ত্র| ভৌগোলিক এবং ভূমিকম্প সংক্রান্ত কারণ বিবেচনা করে তামিলনাড়ুর পশ্চিমঘাট পর্বতমালার স্থিতিশীল ও নিবিড় শিলাস্তর এই ধরনের গুহা তৈরি করার জন্য উপযোগী বলে বিজ্ঞানীরা সুপারিশ করেছেন| প্রস্তাবিত মানমন্দিরটি তামিলনাড়ুর মাদুরাই থেকে ১১০ কিমি দুরে থেনি জেলার পশ্চিম বড়ি পাহাড়ে গড়ে তোলা হবে| এই পাহাড়ে দুটি গুহা তৈরি করা হবে ও একটি ২ কিমি লম্বা সুরঙ্গ মূল প্রবেশপথের সাথে গুহা দুটিকে যুক্ত করবে| এছাড়াও পাহাড়ের নিচে লভ্য জমিতে বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী ও কর্মীদের জন্য আবাসন, ছাত্রছাত্রীদের জন্য ছাত্রাবাস, গবেষণাগার, প্রশাসনিক দপ্তর ও কর্মশালা নির্মাণ করা হবে|

View Larger Map

উপকারিতা

আই এন ও প্রকল্প ভারতবর্ষের বিজ্ঞানপ্রযুক্তি ও মানবসম্পদ উন্নয়নে প্রভূত সাহায্য করবে| এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত করতে গেলে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিকৌশলের প্রয়োগ একান্ত জরুরি| এর ফলে দেশে বিজ্ঞানপ্রযুক্তিতে শক্তিশালী একটি প্রজন্ম গড়ে উঠবে| এই গবেষণায় ব্যবহৃত যন্ত্র চিকিৎসাবিদ্যায় প্রতিচ্ছবি গঠন করা, টমোগ্রাফি ইত্যাদি ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হয়| এই ধরণেরপ্রকল্পে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মেলবন্ধন ঘটে যার ফলে মানবসভ্যতার প্রভূত উপকার সাধিত হয়| এই প্রকল্পে মানবসম্পদের বিপুল বিনিয়োগ হবে| এখানে বিপুল সংখ্যক পদার্থবিদ ও প্রকৌশলী কাজ করবেন যারা হবেন এই প্রকল্পের মূলসম্পদ এবং একে সার্থক করে তুলতে প্রধান ভুমিকা পালন করবেন| ইতিমধ্যেই ভারতবর্ষের কয়েকটি অন্যতম গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় এই প্রকল্পে সক্রিয়ভাবে যুক্ত|

বর্তমানে মুম্বইয়ের টাটা ইন্সটিট্যুট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের বিজ্ঞানীরা আর পি সি নির্মাণ ও আনুসঙ্গিক বৈদ্যূতিন যন্ত্র তৈরিতে যুক্ত আছেন| মুম্বইয়ের ভাবা এটমিক রিসার্চ সেন্টার ও কলকাতার ভারিয়েবেল এনার্জি সাইক্ল্ওট্রন সেন্টারের প্রকল্প সহযোগীরা তড়িৎচুম্বক গঠনে সাহায্য করছেন| সম্প্রতি আই এন ও স্নাতক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু হয়েছে যার মধ্য দিয়ে Ph.D. প্রাপক ছাত্রছাত্রীদের নিউট্রিনো গবেষণার বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিক্ষিত করে তোলা হয়| ছাত্রছাত্রীরা এক বছরের পাঠ্যক্রমে উত্তীর্ণ হবার পর বিভিন্ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানে গবেষণায় যোগদান করে| বিস্তারিত তথ্যের জন্য আমাদের ওয়েবসাইট দেখুন|